এক জুন বৃহস্পতিবার বিকালে নিউইয়র্ক সিটির কুইন্সের একটি ফুড ব্যাংকের সামনে এভাবেই প্রাচীর সাথে নিজের ট্রলিটি রেখে লাইন বুক দিয়ে রেখেছেন কেউ কেউ। অথচ খবার দেয়া হবে শুক্রবার সকাল ১০টা থেকে। ছবি-রুদ্র মাসুদ।
বাংলা কোন গানই পুরাটা পারিনা। দুই একলাইন করে যা পারি, তা-ই গাওয়ার চেষ্টা করি পথ চলতে। যখন মন ভালো থাকে, এই হচ্ছে কথা। আজ দেশের এই গানটি গাইতে গাইতে বাজার করতে যাচ্ছিলাম। এই পদ্মা এই মেঘনা এই যমুনা সুরমা নদী তটে......কতো আনন্দ বেদনায়, মি-ল-ন বিরহ সংকটে... গাওয়ার পরই ছবির দৃশ্যটি দেখে গলা ধরে আসে। গত ক’দিন ধরে চটে থাকা মেজাজ আরো বিগড়ে যায়। ক্ষোভে গলাটা বন্ধ হয়ে আসে।
সময় থাকলেও একদিনে একটার বেশী নিউজের কাজ করতে পারিনা। এক ছোটভাইকে আগে কথা দিয়েছিলাম তাঁদের নিউজটা আজ করে দিবো। অথচ; কথা রক্ষা করতে পারিনি। চটে যাওয়া রাগটা দমাতে যদি এই লিখার আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা।
দ্রব্যমূলের উর্ধ্বগতির কারণে যারা প্রত্যাহিক ব্যায় নির্বাহে হিমশিম খাচ্ছেন তাঁদের সহায়তার জন্য এলাকায় এলাকায় এরকম ফুড ব্যাংক রয়েছে। লিখার সাথের ছবিটা বৃহস্পতিবার বিকালে নিউইয়র্কের একটি ফুড ব্যাংকের সামনের। শুক্রবার সকাল ১০টা থেকে খাবার বিতরণ শুরু হয়। নিজের প্রয়োজনীয় খাবারটুকু পাবেন কিনা এমন উদ্বিগ্ন নাগরিকেরা বৃহস্পতিবার বিকাল থেকে ট্রলিটি ফুডব্যাংকের প্রাচীরের সাথে তালা দিয়ে লাইন বুক দিয়ে রাখেন।
ট্রলি রেখে লাইন বুক দেয়া ব্যাক্তিদের মধ্যে বাংলাদেশীও আছেন। যাদের একজনকে আমি চিনি। তিনি পরিবার পরিজন নিয়ে নিউইয়র্কে থাকেন। দেশে টাকা পাঠাতেই হবে এমন কেউ নেই তাঁর। তবু; প্রতিমাসে আত্মীয়-স্বজনদের কারোনা কারো জন্য সাধ্যানুযায়ী কিছু টাকা পাঠান তিনি। প্রচন্ড শীতের সময় একদিন আক্ষেপ করে তিনি বলেছিলেন- তীব্র শীতেও এতো কষ্ট করে খাবারের জন্য লাইনে দাঁড়াই। যা-ই পারি কষ্টের টাকা দেশে পাঠাই। কিন্তু যখন শুনি দেশ থেকে টাকা পাচার হয়ে আসে। তখন কষ্টটা আরো বেড়ে যায়।
বুঝতে পারছেন কতটুকু কষ্ট বুকে চেপেও একজন প্রবাসী দেশে রেমিটেন্স পাঠান। সেটি সৌদি আরবের হোক আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রবাসী হোক। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীরা এখন দেশে রেমিটেন্স প্রেরণে শীর্ষে। এটিও এখন কাল হয়েছে। গত ক’দিন ধরে এনিয়ে সরব আলোচনা হচ্ছে বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বলা হচ্ছে পাচারের অর্থ রেমিটেন্স হয়ে দেশে ফিরছে। সেজন্যই তাঁরা বলছেন এটি অস্বাভাবিক। কয়েকজন অর্থনীতিবিদ এই প্রশ্নের সূচনাকারী। রাজনীতির ফায়দা হাসিলকারী ও তাঁদের অনুসারীরা এটি চাউর করছেন।
ঢাকায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সভাকক্ষে বসে যেসকল বরেণ্য অর্থনীতিবিদরা নানান তথ্য উপাত্ত দিয়ে এই প্রশ্নের সূত্রপাত ঘটিয়েছেন তাঁরা বর্তমান সময়ের রাজনীতির অংশ। আমার অন্তত সেটি মনে হয়। তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে আরো বেশী আগ্রহী করতেই এমনটি করেছেন। যদিও যুক্তরাষ্ট্র নিজ থেকেই এসব নিয়ে সজাগ।
সৌদি আরবে বেশী প্রবাসী থাকার পরও রেমিটেন্স কমে যাওয়াকে যুক্তি হিসাবে তুলে ধরেছেন তাঁরা । আমাদের এজাতীয় গবেষকদের সাথে কিতাবের সম্পর্ক যুতটুকু মাঠের সম্পর্ক ততটুকুই উল্টো। আর তাঁদের অনুসারিদেরও একই অবস্থা। সৌদি রিয়ালের বিপরীতে টাকার মূল্যমান আর ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান কিংবা সৌদি আরবে একজন প্রবাসীর আয় (টাকার হিসাবে) আর যুক্তরাষ্ট্রে একজন প্রবাসী কত আয় (টাকার হিসাবে) করেন সেটি উল্লেখ করেননি।
সিপিডির বরেণ্য অর্থনীতিবিদরা ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ১২ লাখ ৩০ হাজার লোক সৌদি আরব গেছেন বলে উল্লেখ করেছেন কিন্তু কতজন যুক্তরাষ্ট্র গেছেন সেই হিসাব দিতে পারনেনি। কারণ তাঁরা সেই হিসাব রাখা দরকার মনে করেন-না। আর যারা রাজনীতির মাঠে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টা নিয়ে ট্রল করছেন তাঁরা যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীদের কতবড় ক্ষতি করছেন সেটি নিজেরাই দেখবেন কিছু দিনের মধ্যে। যার মধ্যদিয়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সম্ভাবনার রেমিটেন্সকে ঝুঁকিতে ফেলেছেন তাঁরা।
একটা ছোট্ট তথ্য দিই। শুধুমাত্র নিউইয়র্ক সিটিতে ফুড ডেলিভারিতে নিয়োজিত প্রায় ৯০ হাজার বাইকারের মধ্যে ২৫ হাজারেরও বেশি হচ্ছে বাংলাদেশী। যাদের বেশীরভাগই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন। না, সবাই সোনালী ভবিষ্যতের আশায় এখানে আসেননি। দেশে টিকতে না পেরেও এসেছেন এমন অসংখ্য ঘটনা আছে। এটি শুধুমাত্র একটি পেশায় নিয়োজিতদের কথা বলেছি। সকল পেশায় এরকম আছেন।
আমাদের অর্থনীতিবিদরা কি জানেন? এই বাইকাররা কেউ কেউ সৌদি আরবে থাকা একজন প্রবাসীর সর্বোচ্ছ আয়ের থেকেও বেশী আয় করে থাকেন কখনো কখনো। কতটাকা ব্যায় হয় এরা যুক্তরাষ্ট্রে আসতে? আমাদের গবেষকরা জানেন? পায়ে বেঁধে রাখা ডিভাইস নিয়ে তাঁদের দিনকাটে কতটা অনিশ্চয়তায়। তা কেবলমাত্র ভুক্তভোগীরাই জানেন।
বাংলাদেশের জনগণকে নিয়ে সকল দল, মহল রাজনীতি করে। জনগণের মঙ্গলের চেয়ে ক্ষতি করেন, দেশতক দেশের বারোটা বাজিয়ে দেন। আমাদের অর্থনীতিবিদরাও এমনই। শেখ হাসিনা একাধিক শীর্ষ অর্থনীতিবিদকে রাষ্ট্রীয় একাধিক্ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান করেছেন। তাঁরা যোগ্যতার পরিচয় দিতে পারেননি। বরঞ্চ দেশকে ডুবিয়েছেন, নিজে ডুবেছেন, প্রতিষ্ঠান ডুবিয়েছেন।
আমার এই ভাবনা একজন শ্রমজীবি প্রবাসী হিসাবে। আমি অর্থনীতির ছাত্র নই, অর্থনীতির কোন কিছু বুঝিও না। কিন্তু মানুষকে বুঝার চেষ্টা করি একজন গণমাধ্যম কর্মী হিসাবে। যখন কোন টগবগে যুবক বলে “ভাইয়া, টানা ২৬দিন রিমান্ড খেটে বেরিয়ে চলে এসেছি। ভারি কাজ করতে পারিনা,কোমরে ব্যাথা অনুভব হয়।" কিংবা কোন তরুন বলে “আমেরিকা আসার পরও তার নামে দুটো মামলা হয়েছে” তখন মনে হয়না সেই তরুন-যুবকটি শুধুমাত্র ডলার কামাইয়ের জন্য আমেরিকা এসেছে। অথচ এসব নিয়ে বরেণ্য ব্যাক্তিদের কথা বলতে দেখিনা।
প্রায়ই শুনতে পাই অমুক নেতা-পাতিনেতা, সরকারি কর্মকর্তা, ব্যাবসায়ী দেশ থেকে পাচারকৃত টাকায় বিদেশে সাম্রাজ্য গড়েছেন। ধরে নিচ্ছি রেমিটেন্স হিসাবে সেই টাকাই গেছে বলে প্রচার করা হচ্ছে। কই এমন ৫জন পাচারকারীর নামও প্রকাশ করা হলোনা। কারা পাচার করা অর্থ রেমিটেন্স আকারে ফিরিয়ে নিচ্ছে এমন একজনের নামও তো বলা হয়না। অথচ অভিযোগের তীরটা ছোড়া হলো যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিটেন্স প্রেরণকারীদের।
রেমিটেন্স সংক্রান্ত একটু তথ্য দিই। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে গত জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে রেমিটেন্স গেছে ৩৬৪ দশমিক ৩৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আর সৌদি আরব থেকে গেছে ৩৪৯ দশমিক ৬৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ডিসেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে রেমিটেন্স গেছে ৪২৮ দশমিক ২৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আর সৌদি আরব থেকে গেছে ৩০৬ দশমিক ৩৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তখনও রেমিটেন্স নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য হয়নি।
জানুয়ারি মাসে আবার যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে রেমিটেন্স গেছে ২৯৮ দশমিক ৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আর সৌদি আরব থেকে গেছে ৩০৮ দশমিক ৭২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এইমাসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিটেন্স কমে গেলেও কিন্তু বেড়েছে সৌদি আরব থেকে। একই ধারা ছিলো ফেব্রুয়ারি এবং এপ্রিলে। মাঝখানে মার্চে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেশী রেমিটেন্স যায়। প্রবাসীদের রেমিটেন্স প্রেরণের সাথে তাঁদের আয়ের বিষয়টি জড়িত। সাধারণত সংশ্লিষ্ট দেশের আবহাওয়ার সাথেও আয়-রোজগারের সম্পর্ক জড়িত।
আমাদের গবেষণায় এই বিষয়গুলোর ন্যূনতম ফোকাসও হয়না। অথচ যখন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি ঘোষিত হলো তখন নানান পক্ষ ফায়দা লোটার চেষ্টা করছে। যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করা হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ কাজে তখন আমরা পড়ে আছি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ফরমায়েশি ব্রিফিংয়ে। সরকারের কোন মন্ত্রী যখন বিদেশে অর্থপাচার নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ খোলেন তখন আবার কোন মন্ত্রী কিংবা গুরুত্বপূর্ণ নেতা তা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেন। আবার কেউ কেউ সরকারের বিরোধীতা করতে গিয়ে দেশের বিরুদ্ধে লাগেন। কথা উঠে যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ করে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাবিত করা হয়। তাহলে বাংলাদেশ সরকার এবং সরকারি দলের লোকজন কেনো যুৎসই কোন পদক্ষেপ নেয়না।
যুুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রেরিত রেমিটেন্স নিয়ে সাম্প্রতিক আলোচনা প্রসঙ্গে লিখাটা শুরু করেছিলাম। সেই প্রসঙ্গেই শেষ কথাটা বলছি। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মাগারিবের নামাজ শেষে বের হওয়ার পর একজন জানালেন কয়েকদিন আগে তাঁর দুই চাচাতো ভাই এসেছেন সীমান্ত পাড়ি দিয়ে। তাঁর মামলাটিও অবশ্য এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। আর এই লিখাটা যখন শুরু করেছিলাম তখন মুঠোফোনে ছোট্ট একটি খুদে বার্তা ভেসে উঠে। যেখানে ইংরেজিতে লিখা আছে "কেস উইন হইছে ভাইয়া" (Case win hoiche vaia) । এক তরুণ আজকে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য তাঁর মামলাটির রায় পেয়েছেন নিজের পক্ষে।
দুইটি পৃথক সত্য ঘটনার আজকের উদাহরণ দিলাম। প্রিয় পাঠক সহজে বুঝে নেন কি পরিমান বাংলাদেশী প্রতিনিয়ত যুক্তরাষ্ট্র আসছে তা বুঝার জন্য। স্টুডেন্ট ভিসা, চাকরি ভিসা, ভ্রমন ভিসা কিংবা পারিবারিক ভিসায় আরো কতো আসছে সেই হিসাব পরে অন্যকোন লিখায় জানানোর চেষ্টা করবো।
যুক্তরাষ্ট্র তাঁর নীতি অনুযায়ী গণতন্ত্র, সুশাসন, মানবাধিকারসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলে। শীর্ষ রেমিটেন্স প্রেরণকারী দেশ হিসাবে সেই সুযোগ আরো বেশী। আমরা নিজেদের স্বার্থে দেশের বিরুদ্ধে যেনো কথা না বলি। কেউ বললে যেনো তিনি নির্দিষ্ট তথ্য উপাত্ত দিয়ে কথা বলেন। কারণ এতে প্রবাসীরা ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারেন। গড়পড়তা কথা নয়, সুনির্দিষ্ট কথা হোক পাচারকারীর বিরুদ্ধে।
ফরিদা পারভিনের গাওয়া কালজয়ী এই দেশাত্মবোধক গানের কথার মতোই- যতো আনন্দ বেদনায়, মিলন বিরহ সংকটেই থাকুক প্রবাসীরা কিন্তু দেশে রেমিটেন্স পাঠানো বন্ধ করেনা। দেশকে ভালোবেসে এবং স্বজনদের প্রতি কর্তব্য থেকেই সেটি চলমান থাকে।
#
লেখক-
সম্পাদক, দেশি খবর।
সম্পাদক : মাহমুদুল হাসান (রুদ্র মাসুদ)
ঠিকানাঃ ৮৬-৩২ ১০২ এভিনিউ, ওজন পার্ক, দ্বিতীয় তলা, নিউ ইয়র্ক, এনওয়াই-১১৪১৬, ইউএসএ
© 2024 Deshi Khobor All Rights Reserved. Developed By Root Soft Bangladesh.